সোহেল তাজ, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতির বিরুদ্ধে বিস্ফোরক কিছু মন্তব্য করেছেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ভেতরের অসঙ্গতি, দুর্নীতি, এবং তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যা তাঁকে রাজনীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে।
শেখ হাসিনার “দুই হাতে টাকা বানানোর” মন্তব্য
সোহেল তাজ বলেন, তিনি শেখ হাসিনাকে একসময় অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু একটি ঘটনার পর তাঁর সেই শ্রদ্ধা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়। তিনি বলেন, একবার আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “বিএনপি অনেক টাকা বানিয়েছে, এখন আমাদেরও দুই হাতে টাকা বানাতে হবে।” সোহেল তাজের মতে, এই ধরনের মন্তব্য একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আসা মোটেই উচিত নয় এবং এটি তাঁর কাছে অত্যন্ত হতাশাজনক ছিল। এই ঘটনার পর থেকেই শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর আর কোনো শ্রদ্ধা অবশিষ্ট ছিল না।
রাজনীতিতে আসার স্বপ্ন এবং প্রথম দিকে সংগ্রাম
সোহেল তাজের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে। তিনি আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরেন এবং দেশের জন্য কিছু করতে চান। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন। সেসময় আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হলেও, সোহেল তাজ নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন এবং বিরোধী দলের একজন সক্রিয় নেতা হিসেবে কাজ করেন।
বিরোধীদলে থাকাকালীন সময়ে সোহেল তাজ বেশ কয়েকবার পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। তিনি জানান, বিরোধী দল হিসেবে তিনি আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং পুলিশের লাঠিপেটা সহ্য করেন। কিন্তু তাঁর সেই সংগ্রাম তাঁকে রাজনীতি থেকে সরাতে পারেনি। বরং, তিনি দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যান।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া এবং হতাশা
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন দিনবদলের সনদ ঘোষণা করে ক্ষমতায় আসে, তখন সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। দিনবদলের সেই প্রতিশ্রুতি এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করে ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত করা।
কিন্তু শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁর সামনে অনেক বাধা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, কিছু অদৃশ্য শক্তি তাঁর পদক্ষেপগুলোতে বাধা দিচ্ছে এবং মন্ত্রণালয়ের ভেতরে থেকে ম্যানুপুলেশনের চেষ্টা চলছে। তিনি বদলি বাণিজ্য বন্ধের উদ্যোগ নেন এবং পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার আনার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেই প্রচেষ্টাগুলো সফল হয়নি।
সোহেল তাজ আরও জানান, “আমি মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে বলেছিলাম, আজ থেকে বদলি বাণিজ্য বন্ধ। কিন্তু আমি দেখতে পাই, আমার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম, দিনবদলের সনদ আসলে ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।”
বিডিআর হত্যাকাণ্ড এবং দায়িত্বহীনতা
২০০৯ সালে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) হত্যাকাণ্ডের সময় সোহেল তাজ আমেরিকায় তাঁর মেয়ের জন্মদিন উদযাপন করছিলেন। যখন পিলখানায় গোলাগুলি শুরু হয়, তখন তিনি আমেরিকায় ছিলেন এবং ফোনের মাধ্যমে ঘটনাটি জানতে পারেন। তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদকে ফোন করে তিনি রেসকিউ ফোর্স পাঠানোর নির্দেশ দেন, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া পাননি।
তিনি বলেন, “আইজিপি আমাকে বলেছিলেন যে, কোনো নির্দেশনা পাননি এবং মন্ত্রী মহোদয় উপস্থিত আছেন। আমি তখন বুঝলাম, আমার নির্দেশ অনুসরণ করা হচ্ছে না।” এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন এবং তাঁকে পরিস্থিতি জানান। কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁকে ধমকের সুরে বলেন, “আমেরিকায় বসে এত বোঝার দরকার নেই, আমি দেখছি।”
সোহেল তাজের অভিযোগ ছিল, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর একটি অপপ্রচার চালানো হয় যে, তিনি নাকি হত্যাকারীদের পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বলেন, “এ ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং আমি সেই সময় দেশে আসিনি। দেশে ফিরে এসেছি ঘটনার অনেক দিন পর।”
পদত্যাগের সিদ্ধান্ত এবং হাসিনার গান
সোহেল তাজ ২০০৯ সালের ৩১ মে প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর পদত্যাগপত্র নিতে চাননি। পরে সোহেল তাজ আমেরিকা থেকে ফোনে তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। সোহেল তাজ আরও জানান, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে নানা রকম অফার করেছিলেন, দলীয় পদ-পদবি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোনো কিছুতেই রাজি হননি।
এরপর শেখ হাসিনা ফোনে একটি অদ্ভুত গান গাইতে শুরু করেন। গানটি ছিল, “আমি কাউকে ছাড়ি না, আমি তোমাকে ছাড়ব না।” সোহেল তাজ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ফোনে দুই মিনিট ধরে এই গানটি গাইতে থাকেন। আমি হতবাক হয়ে যাই।” এই ঘটনার পর সোহেল তাজ রাজনীতি থেকে আরও দূরে সরে যান।
রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণ
সোহেল তাজ বলেন, “আমি যে আওয়ামী লীগকে জানতাম এবং চিনি, সেই দলের সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগের কোনো মিল নেই। আজকের আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। এটি সুবিধাবাদী ও লোভীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যারা ক্ষমতার লোভে এবং সম্পদ আহরণে দলটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগ এমন একটি দল ছিল যারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু আজকের আওয়ামী লীগ লুটপাট, দুর্নীতি, হত্যা, গুম এবং অপশাসনের একটি মেশিনে পরিণত হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সরকারের ভেতরে বসে কেউ কিছুই করতে পারছে না।”
নির্বাচন ব্যবস্থা এবং আওয়ামী লীগের ভূমিকা
সোহেল তাজের মতে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তিনি বলেন, “২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন। ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল রাতের ভোটের নির্বাচন এবং সাম্প্রতিক নির্বাচন ছিল ডামির নির্বাচন। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।”
নিরাপত্তা হুমকি এবং ব্যক্তিগত জীবনে আঘাত
সোহেল তাজ আরও অভিযোগ করেন যে, তাঁর পরিবারও সরকারের অন্যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। তাঁর ভাগিনাকে রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে অপহরণ করা হয়েছিল এবং ১১ দিন ধরে আয়নাঘরে আটক রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার ভাগিনাকে আটক করা হয়েছিল একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ইশারায়। এটা আমরা কখনো চাইনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এরকম ছিল না।”
সোহেল তাজের বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে একটি গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। তাঁর অভিযোগগুলো বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুতর। তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য হিসেবে দলের ভেতরের অসঙ্গতি এবং দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তিনি যে আওয়ামী লীগকে জানতেন এবং যে আদর্শে বিশ্বাস করতেন, সেই দলের সঙ্গে আজকের আওয়ামী লীগের কোনো মিল নেই।