মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, যা তাতমাদাও নামে পরিচিত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি। এর সামরিক সরঞ্জাম এবং সক্ষমতা অনেকটাই প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। বিশেষত, চীন, রাশিয়া এবং ভারত থেকে তারা উল্লেখযোগ্য সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে প্রধানত তিনটি শাখা রয়েছে: সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী।
সেনাবাহিনী
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক সরঞ্জামসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া যান:
- মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিভিন্ন প্রকারের ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। তাদের প্রধান ট্যাঙ্কগুলোর মধ্যে রয়েছে T-72S (রাশিয়ায় তৈরি)। এছাড়াও চীনের Type 59, Type 69, এবং Type 96 ট্যাঙ্কও ব্যবহার করা হয়।
- সাঁজোয়া যানের মধ্যে BTR-3U (ইউক্রেন থেকে আমদানি) এবং WS-22 উল্লেখযোগ্য।
- অস্ত্রশস্ত্র:
- সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা প্রধান অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের আর্মড রাইফেল, যেমন: AK-47, QBZ-97 (চীনের তৈরি), এবং G3 রাইফেল।
- রকেট লঞ্চার এবং আর্টিলারি ইউনিটগুলির জন্য তারা BM-21 Grad মাল্টিপল রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে। এছাড়া NORINCO থেকে বিভিন্ন ধরনের মিসাইল ও রকেট সিস্টেম আমদানি করা হয়েছে।
- সামরিক ড্রোন:
- সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার সামরিক ড্রোনের উপর বেশি জোর দিচ্ছে। চীন থেকে আমদানি করা CH-3 এবং CH-4 ড্রোনগুলোর মাধ্যমে তারা নজরদারি এবং আক্রমণের কাজ সম্পন্ন করে।
- এই ড্রোনগুলো তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করে তুলেছে।
নৌবাহিনী
মিয়ানমার নৌবাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের সমুদ্রসীমা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিরক্ষা। নৌবাহিনীতে তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রণতরী এবং সাবমেরিন ব্যবহার করে:
- সাবমেরিন:
- নৌবাহিনীতে সম্প্রতি ভারতের সহায়তায় Kilo-class সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে। এই সাবমেরিনগুলো পানির নিচে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে সক্ষম এবং মিসাইল, টর্পেডো ইত্যাদি বহন করতে পারে।
- করভেট এবং ফ্রিগেট:
- মিয়ানমার নৌবাহিনী Aung Zeya-class এবং Kyan Sittha-class করভেট ব্যবহার করে। এছাড়া তাদের Anawrahta-class ফ্রিগেটগুলো আঞ্চলিক সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা কাজে ব্যবহার হয়।
- মিসাইল এবং টর্পেডো:
- নৌবাহিনীর প্রধান মিসাইল ব্যবস্থার মধ্যে চীনের তৈরি C-802 এবং C-801 অ্যান্টি-শিপ মিসাইল রয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার সহায়তায় তারা টর্পেডো এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করেছে।
বিমানবাহিনী
মিয়ানমার বিমানবাহিনীর প্রধান ক্ষমতা আসে তাদের যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার থেকে। তাদের সামরিক বিমানবহর প্রধানত চীন এবং রাশিয়ার তৈরি বিমানের উপর নির্ভরশীল:
- যুদ্ধবিমান:
- প্রধান যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে রাশিয়ার তৈরি MiG-29, চীনের Chengdu JF-17, এবং K-8 Karakorum উল্লেখযোগ্য।
- এ বিমানগুলো আকাশ থেকে আকাশ এবং আকাশ থেকে ভূমি আক্রমণের জন্য ব্যবহার করা হয়।
- হেলিকপ্টার:
- বিমানবাহিনীতে রাশিয়ার Mi-24 Hind এবং Mi-35 হেলিকপ্টারগুলো বড় ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের পরিবহন এবং আক্রমণকারী হেলিকপ্টারও আছে।
- ড্রোন এবং নজরদারি ব্যবস্থা:
- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমার বিমানবাহিনী ড্রোনের উপরও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। চীন থেকে Wing Loong এবং CH-4 ড্রোন আমদানি করা হয়েছে।
সক্ষমতা এবং চ্যালেঞ্জ
- মানবসম্পদ:
- মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রায় ৫ লাখ সক্রিয় সদস্য আছে, যা তাদের একটি উল্লেখযোগ্য মানবসম্পদ প্রদান করে। তবে, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এখনও কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে।
- প্রযুক্তি এবং সরঞ্জামের সীমাবদ্ধতা:
- মিয়ানমারের সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি এখনও অনেকাংশেই পুরনো এবং সীমিত। চীন, রাশিয়া এবং ভারতের সহায়তায় কিছু নতুন প্রযুক্তি সংযোজন হলেও, দেশীয় প্রযুক্তি উন্নয়নে পিছিয়ে আছে।
- অভ্যন্তরীণ সংঘাত:
- মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সম্মুখীন। বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াইয়ে তাদের সামরিক বাহিনী সম্পৃক্ত। এই সংঘাতগুলো সামরিক বাহিনীর সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে।
- আন্তর্জাতিক চাপ এবং নিষেধাজ্ঞা:
- মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং বিভিন্ন দেশের আরোপিত বাধার কারণে তাদের সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ অর্জনে বাধা সৃষ্টি হয়। বিশেষত, রোহিঙ্গা নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। তবে, তাদের সামরিক সরঞ্জাম এবং সক্ষমতা এখনও মূলত চীন, রাশিয়া এবং ভারত থেকে আমদানি করা সরঞ্জামের উপর নির্ভরশীল। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও, তারা সামরিক আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তি এবং বিমানবাহিনীর উন্নয়নে জোর দিচ্ছে।